ভারতের সংবিধান প্রণয়ন || Framing of the Constitution
একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড হলো তার সংবিধান। ভারত যখন দীর্ঘ ব্রিটিশ শাসনের শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতার আলোয় পা রাখছিল, তখন কোটি কোটি মানুষের অধিকার রক্ষা এবং বৈচিত্র্যময় এই দেশকে একসূত্রে বাঁধার জন্য প্রয়োজন ছিল একটি বলিষ্ঠ দলিল। সেই তাগিদ থেকেই শুরু হয়েছিল বিশ্বের দীর্ঘতম লিখিত সংবিধান রচনার এক বিশাল যজ্ঞ।
ভারতের সংবিধান কোনো একদিনে তৈরি হয়নি। এটি ছিল প্রায় তিন বছরের নিরলস পরিশ্রম, চুলচেরা বিশ্লেষণ এবং দূরদর্শী চিন্তাভাবনার ফসল। ডঃ বি. আর. আম্বেদকরের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এবং গণপরিষদের অগণিত সদস্যদের অবদানে ভারত পেয়েছিল এমন একটি শাসনতন্ত্র, যা আজও আমাদের গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছে। আজকের এই ব্লগে আমরা জানবো সেই ঐতিহাসিক যাত্রার গল্প—কীভাবে ধাপে ধাপে রচিত হয়েছিল আমাদের ভারতীয় সংবিধান।
সংবিধান রচনার প্রেক্ষাপট (Background of the Constitution)
ভারতের সংবিধান হঠাৎ করে আকাশ থেকে পড়েনি; এর পেছনে ছিল দীর্ঘদিনের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক সংস্কারের ইতিহাস।
- প্রাথমিক দাবি (১৯৩৪): ভারতে একটি গণপরিষদ গঠনের দাবি প্রথম উত্থাপন করেছিলেন এম. এন. রায় (M.N. Roy)। পরবর্তীতে ১৯৩৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস আনুষ্ঠানিকভাবে এই দাবি জানায়।
- ব্রিটিশ স্বীকৃতি (১৯৪০): ১৯৪০ সালের 'অগাস্ট অফার'-এ ব্রিটিশ সরকার প্রথমবারের মতো ভারতীয়দের দ্বারা সংবিধান রচনার দাবিটি নীতিগতভাবে মেনে নেয়।
- ক্রিপস মিশন (১৯৪২): স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস একটি খসড়া প্রস্তাব নিয়ে ভারতে আসেন, যেখানে বলা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারত নিজের সংবিধান নিজে তৈরি করবে। কিন্তু মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেস উভয়ই এটি প্রত্যাখ্যান করে।
- ক্যাবিনেট মিশন (১৯৪৬): অবশেষে ১৯৪৬ সালের ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান অনুযায়ী ভারতের সংবিধান রচনার জন্য 'গণপরিষদ' (Constituent Assembly) গঠিত হয়। এই মিশনটিই সংবিধান রচনার পথ প্রশস্ত করে দেয়।
ব্রিটিশ আইনের প্রভাব
ভারতীয় সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ আমলের বেশ কিছু আইনের গভীর প্রভাব রয়েছে, বিশেষ করে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন (Government of India Act, 1935)। বর্তমান সংবিধানের প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ কাঠামো এই আইন থেকে নেওয়া হয়েছে।
ভারতের সংবিধান রচনার মূল কারিগর ছিল গণপরিষদ (Constituent Assembly)। এটি কোনো সাধারণ সভা ছিল না, বরং ভারতের সকল প্রান্তের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ ছিল। নিচে গণপরিষদের গঠনশৈলী বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
গণপরিষদ গঠন (Composition of the Constituent Assembly)
১৯৪৬ সালে ক্যাবিনেট মিশনের (Cabinet Mission Plan) সুপারিশ অনুযায়ী গণপরিষদ গঠিত হয়। এর গঠন ছিল নিম্নরূপ:
-
মোট সদস্য সংখ্যা: প্রাথমিকভাবে গণপরিষদের মোট সদস্য সংখ্যা নির্ধারিত হয়েছিল ৩৮৯ জন।
- ২৯২ জন: ব্রিটিশ শাসিত ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের প্রতিনিধি।
- ৯৩ জন: দেশীয় রাজ্যসমূহের (Princely States) প্রতিনিধি।
- ৪ জন: চিফ কমিশনার শাসিত প্রদেশ (দিল্লি, আজমেঢ়-মারওয়ার, কুর্গ ও ব্রিটিশ বালুচিস্তান) থেকে।
- সদস্য নির্বাচন পদ্ধতি: গণপরিষদের সদস্যরা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হননি। তাঁরা প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রতি ১০ লক্ষ জনসংখ্যা পিছু একজন করে প্রতিনিধি পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
- ধর্মীয় সম্প্রদায়ভিত্তিক আসন: আসনগুলো মূলত তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিল— সাধারণ, মুসলিম এবং শিখ।
দেশভাগের প্রভাব ও সদস্য সংখ্যার পরিবর্তন
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পর এবং পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে গণপরিষদের সদস্য সংখ্যা হ্রাস পায়।
- মুসলিম লীগের সদস্যরা সরে যাওয়ায় সদস্য সংখ্যা ৩৮৯ থেকে কমে দাঁড়ায় ২৯৯ জনে।
- এর মধ্যে ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর সংবিধান চূড়ান্ত হওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন এবং স্বাক্ষর করেছিলেন ২৮৪ জন সদস্য।
পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব
গণপরিষদে ভারতের তৎকালীন সময়ের শ্রেষ্ঠ মেধাবী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা উপস্থিত ছিলেন।
- অস্থায়ী সভাপতি: ডঃ সচ্চিদানন্দ সিনহা (সবচেয়ে বয়স্ক সদস্য হিসেবে)।
- স্থায়ী সভাপতি: ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ (১১ ডিসেম্বর, ১৯৪৬-এ নির্বাচিত)।
- সাংবিধানিক উপদেষ্টা: বি. এন. রাউ (B.N. Rau)।
- খসড়া কমিটির চেয়ারম্যান: ডঃ বি. আর. আম্বেদকর।
একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য: যদিও ভারতের জাতীয় কংগ্রেস গণপরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, তবুও এখানে বিভিন্ন মতাদর্শ ও পেশার মানুষ (আইনজীবী, শিক্ষক, সমাজকর্মী) ছিলেন, যা সংবিধানকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রূপ দিয়েছিল।
খসড়া কমিটি এবং সংবিধান রচনার বিভিন্ন পর্যায়
গণপরিষদের অসংখ্য কমিটির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল খসড়া কমিটি। ১৯৪৭ সালের ২৯ আগস্ট এই কমিটি গঠন করা হয়। এর মূল দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন কমিটির প্রস্তাবগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে সংবিধানের একটি খসড়া রূপ তৈরি করা।
খসড়া কমিটির সদস্যবৃন্দ:
ডঃ বি. আর. আম্বেদকরের নেতৃত্বে এই কমিটিতে মোট ৭ জন সদস্য ছিলেন:
১. ডঃ বি. আর. আম্বেদকর (চেয়ারম্যান)
২. এন. গোপালস্বামী আয়ঙ্গার
৩. আল্লাদি কৃষ্ণস্বামী আয়ার
৪. ডঃ কে. এম. মুন্সী
৫. সৈয়দ মহম্মদ সাদুল্লা
৬. এন. মাধব রাও (বি. এল. মিত্তরের পরিবর্তে)
৭. টি. টি. কৃষ্ণমাচারী (ডি. পি. খৈতানের মৃত্যুর পর)
সংবিধান প্রণয়নের সময়কাল (The Timeline)
ভারতের সংবিধান একদিনে বা এক মাসে তৈরি হয়নি। এর জন্য দীর্ঘ সময় এবং গভীর আলোচনার প্রয়োজন ছিল:
- মোট সময়: সংবিধান তৈরি করতে সময় লেগেছিল ২ বছর, ১১ মাস এবং ১৮ দিন।
- মোট অধিবেশন: এই দীর্ঘ সময়ে গণপরিষদের মোট ১১টি অধিবেশন বসেছিল।
- খসড়া আলোচনা: খসড়া সংবিধানের ওপর প্রায় ১১৪ দিন ধরে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা ও বিতর্ক চলে। এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ২,৪৭৩টি সংশোধন প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল।
সংবিধান গ্রহণ ও কার্যকর (Adoption and Enactment)
দীর্ঘ আলোচনার পর ১৯৪৯ সালের শেষদিকে সংবিধান চূড়ান্ত রূপ পায়:
- ২৬ নভেম্বর, ১৯৪৯: এই ঐতিহাসিক দিনে গণপরিষদ কর্তৃক ভারতের সংবিধান গৃহীত (Adopted) হয়। এই দিনটিকে বর্তমানে ভারতে 'সংবিধান দিবস' হিসেবে পালন করা হয়।
- ২৬ জানুয়ারি, ১৯৫০: এই দিন থেকে সংবিধান পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর (Commencement) হয় এবং ভারত একটি সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই দিনটিকে আমরা 'প্রজাতন্ত্র দিবস' হিসেবে পালন করি।
সংবিধানের মূল কাঠামো (প্রাথমিক অবস্থা)
যখন সংবিধান গৃহীত হয়, তখন এতে ছিল:
- ১টি প্রস্তাবনা (Preamble)
- ৩৯৫টি ধারা (Articles)
- ২২টি অংশ (Parts)
- ৮টি তফসিল (Schedules)
মজার তথ্য: ভারতের মূল সংবিধানটি হাতে লেখা (Calligraphed) ছিল। এটি প্রেম বিহারী নারায়ণ রাইজাদা হিন্দি এবং ইংরেজি উভয় ভাষায় অত্যন্ত সুন্দরভাবে লিখেছিলেন।
ভারতের সংবিধান রচনার বিশাল কাজটিকে সুচারুভাবে সম্পন্ন করার জন্য গণপরিষদ বেশ কয়েকটি ছোট-বড় কমিটিতে বিভক্ত হয়েছিল। এই কমিটিগুলো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় (যেমন: মৌলিক অধিকার, কেন্দ্রীয় ক্ষমতা, প্রাদেশিক শাসন) নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা ও আলোচনা করে তাদের রিপোর্ট জমা দিত।
নিচে প্রধান কমিটিগুলোর একটি তালিকা দেওয়া হলো:
প্রধান কমিটিসমূহ (Major Committees)
গণপরিষদে মোট ৮টি প্রধান কমিটি ছিল, যেগুলোর নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন ভারতের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ:
|
কমিটির নাম |
চেয়ারম্যান/প্রধান |
|---|---|
|
খসড়া কমিটি (Drafting Committee) |
ডঃ বি. আর. আম্বেদকর |
|
কেন্দ্রীয় ক্ষমতা কমিটি (Union Powers Committee) |
জওহরলাল নেহেরু |
|
কেন্দ্রীয় সংবিধান কমিটি (Union Constitution Committee) |
জওহরলাল নেহেরু |
|
প্রাদেশিক সংবিধান কমিটি (Provincial Constitution Committee) |
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল |
|
মৌলিক অধিকার এবং সংখ্যালঘু বিষয়ক কমিটি |
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল |
|
কার্যবিধি নিয়মাবলি কমিটি (Rules of Procedure Committee) |
ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ |
|
রাজ্য কমিটি (States Committee - রাজ্যগুলোর সাথে আলোচনার জন্য) |
জওহরলাল নেহেরু |
|
সঞ্চালন বা স্টিয়ারিং কমিটি (Steering Committee) |
ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ |
কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপ-কমিটি (Important Sub-committees)
সর্দার প্যাটেলের নেতৃত্বাধীন 'মৌলিক অধিকার ও সংখ্যালঘু বিষয়ক' কমিটির অধীনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপ-কমিটি ছিল:
- মৌলিক অধিকার উপ-কমিটি: জে. বি. কৃপালনী।
- সংখ্যালঘু উপ-কমিটি: এইচ. সি. মুখার্জী।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কমিটি (Minor Committees)
প্রধান কমিটিগুলো ছাড়াও আরও বেশ কিছু ছোট কমিটি ছিল যেগুলো প্রশাসনিক কাজে সহায়তা করত:
- জাতীয় পতাকা সংক্রান্ত অ্যাড-হক কমিটি: ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ।
- গণপরিষদের কার্যাবলী সংক্রান্ত কমিটি: জি. ভি. মাভলঙ্কর।
- হিন্দি অনুবাদ কমিটি: অনেক ক্ষেত্রে এটি সংবিধানের ভাষাগত দিকের দেখাশোনা করত।
এই কমিটিগুলোর গুরুত্ব
এই কমিটি প্রথা অনুসরণ করার ফলে সংবিধানের প্রতিটি ধারা বা আইন পাস হওয়ার আগে সেটির উপর বিশেষ বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা মতামত দেওয়ার সুযোগ পেতেন। যেমন, সর্দার প্যাটেল দেশীয় রাজ্যগুলোকে একত্রিত করার কাজ দেখতেন, তাই প্রাদেশিক বিষয়গুলো তাঁর কমিটির অধীনে ছিল। আবার নেহেরু আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কেন্দ্রীয় কাঠামোর উপর জোর দিতেন।
বিঃদ্রঃ: গণপরিষদের এই কমিটিগুলোর রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই ডঃ আম্বেদকরের খসড়া কমিটি সংবিধানের চূড়ান্ত রূপরেখা তৈরি করেছিল।
ভারতের সংবিধান একটি 'জীবন্ত দলিল'। সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়েও এটি দেশের একতা এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষা করে চলেছে। ডঃ আম্বেদকর ও গণপরিষদের সদস্যদের এই দূরদর্শী অবদানই ভারতকে আজ একটি শক্তিশালী প্রজাতন্ত্র হিসেবে টিকিয়ে রেখেছে।