ভারতীয় রাজনীতি (1935 - 1939 খ্রিষ্টাব্দ) || Indian politics (1935 - 1939 A.D.)

ভারত শাসন আইন, 1935 : সাইমন কমিশনের সুপারিশ এবং প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনার ভিত্তিতে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট 1935 খ্রিস্টাব্দে ‘ভারত শাসন আইন' পাস করে। ব্রিটিশ ভারত ও দেশীয় রাজ্যগুলি কে নিয়ে কেন্দ্রে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের ব্যবস্থা করা হয়। দেশীয় রাজ্যগুলির পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে যোগদান করা সম্পূর্ণ তাদের ইচ্ছাধীন ছিল। কেন্দ্রে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় আইনসভা গঠনের ব্যবস্থা করা হয়। মুসলিম সভ্যদের জন্য সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা ও তপশিলি সভ্যদের জন্য ‘পুনা চুক্তি' অনুসারে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের শাসনভার গভর্নর জেনারেলের অধীন একটি মন্ত্রিপরিষদের উপর ন্যস্ত হয়। গভর্নর জেনারেল তার কাজের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে দায়ী থাকবেন। প্রাদেশিক গভর্নরের নেতৃত্বে প্রদেশগুলিতে স্বায়ত্ব শাসন প্রতিষ্ঠার এবং একটি প্রাদেশিক ‘মন্ত্রিসভা’ গঠনের কথা বলা হয়। তার সদস্যরা প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যদের মধ্যে থেকে মনোনীত হবেন। 1937 খ্রিস্টাব্দে 1লা এপ্রিল থেকে এই আইন কার্যকরী হবে বলে ঘোষণা করা হয়।

1937 খ্রিস্টাব্দের নির্বাচন : 1935 খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইন অনুসারে 1937 খ্রিস্টাব্দে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে 11 টি প্রাদেশিক আইনসভার 1585 টি আসনের মধ্যে 706 টি আসন কংগ্রেস দখল করে। মাদ্রাজ, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, বিহার ও উড়িষ্যা আইনসভায় কংগ্রেস নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। বোম্বাই, বাংলা, আসাম ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে কংগ্রেস একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। 11 টি প্রদেশের আইনসভা গুলির মোট উন্মুক্ত আসন (open seats) সংখ্যা ছিল 657 টি এবং মুসলিমদের জন্য সংরক্ষিত আসন ছিল 485 টি। কংগ্রেস মুসলিমদের জন্য সংরক্ষিত মাত্র 58 টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে 26 টি আসন লাভ করে। অপরপক্ষে মুসলিম লীগ সংরক্ষিত 485 টি আসনে প্রার্থী দিয়ে 108 টি আসন লাভ করে। শ্রমিকদের জন্য মোট আসন ছিল 38 টি। কংগ্রেস 20 টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে 18 টি দখল করে।

কংগ্রেসের মন্ত্রিসভা গঠন : 1937 খ্রিস্টাব্দের 17ই ও 18ই মার্চ দিল্লিতে ‘নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি’র বৈঠকে বামপন্থীদের পক্ষে জয়প্রকাশ নারায়ণ কংগ্রেসের মন্ত্রিসভা গঠনের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পেশ করেন। গান্ধীজি মন্ত্রিত্বগ্রহণে পক্ষে ছিলেন। জয়প্রকাশের প্রস্তাবটির পক্ষে সেদিন 78 টি ও বিপক্ষে 135 টি ভোট পড়ে। স্থির হয় যে, যে সকল প্রদেশে কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে একমাত্র সেই সব স্থানে মন্ত্রিসভা গঠিত হবে। 1937 খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজ, বিহার, উড়িষ্যা, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে কংগ্রেস একক মন্ত্রিসভা গঠন করে। ফজলুল হকের ‘কৃষক প্রজা পার্টি' বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে যুগ্মভাবে সরকার গঠনের ইচ্ছুক ছিল, কিন্তু কংগ্রেস তাতে আপত্তি জানায়।

সারা ভারত কিষান কংগ্রেস : 1934 খ্রিস্টাব্দে আচার্য নরেন্দ্র দেব ও জয়প্রকাশ নারায়ণ এর নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে ‘কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল' প্রতিষ্ঠিত হয়। 1930 খ্রিস্টাব্দের 11 ই এপ্রিল জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন কালে কংগ্রেস সভাপতি জহরলাল নেহেরুর সমর্থনপুষ্ট হয়ে কংগ্রেসের বামপন্থী অংশ কংগ্রেস, সমাজতন্ত্রী দল ও কমিউনিস্টরা ‘সারা ভারত কিষান কংগ্রেস' প্রতিষ্ঠা করে। এন. জি. রঙ্গ ও স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী যথাক্রমে এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি নিযুক্ত হন। 1936 খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে কিষান কংগ্রেসের একটি ইস্তাহারে জমিদারি উচ্ছেদ, কৃষি ঋণ মুকুব, বেগার প্রথার উচ্ছেদ, খাজনার হার 50% হ্রাস, কৃষকদের বন সম্পদ আহরণের পূর্ণ অধিকার, অনাবাদী সরকারি জমি ও জমিদারের খাস জমি কৃষকদের প্রদান প্রভৃতির দাবি জানানো হয় এবং ডিসেম্বরে জাতীয় কংগ্রেসের ফৈজপুর অধিবেশনে এই প্রস্তাবটি স্বীকৃত হয়। 1937 খ্রিস্টাব্দের 14ই জুলাই বিহারের গয়া জেলার নিয়ামতপুরে ‘সারা ভারত কিষান কংগ্রেসের' দ্বিতীয় অধিবেশন বসে এবং এই প্রতিষ্ঠানের নামকরণ হয় ‘সারা ভারত কিষান সভা'।

হরিপুরা কংগ্রেস : 1938 খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের বামপন্থী অংশকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে জাতীয় কংগ্রেসের হরিপুরা অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র বসুকে সভাপতি মনোনীত করা হয়। সুভাষ চন্দ্র ও তার অনুগামী বামপন্থীরা মনে করতেন যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে কখনোই ভারতের জনবল ও সম্পদ যুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে না। সভাপতির ভাষণে তিনি প্রস্তাবিত যুক্তরাষ্ট্র গঠন ও কংগ্রেসের মন্ত্রিসভা গঠনের সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেন। শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনগুলিকে কংগ্রেস এর অধীনে এনে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মঞ্চ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

ত্রিপুরি কংগ্রেস : 1939 খ্রিস্টাব্দে নাম্বুদিরিপাদ, সুন্দরাইয়া, সাজ্জাদ জহির প্রমুখ আটজন বিক্ষুব্ধ বামপন্থী নেতা ত্রিপুরি (মধ্যপ্রদেশ) কংগ্রেস অধিবেশনের জন্য সুভাষ চন্দ্রকে সভাপতি করার দাবি পুনরুত্থাপিত করেন। কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘নিউ এজ'-এ এই দাবি ওঠে। গান্ধীজী আপত্তি জানান এবং মৌলানা আবুল কালাম আজাদকে সভাপতি মনোনীত করেন। মৌলানা আজাদ আপত্তি জানালে পট্টভি সীতারামাইয়া কে প্রার্থী হিসেবে স্থির করা হয়। 1939 খ্রিস্টাব্দের 29 শে জানুয়ারি, এই নির্বাচনে সুভাষচন্দ্র 1580 এবং সীতারামাইয়া 1377 টি ভোট পান। সুভাষচন্দ্র 203 টি ভোটে জয়যুক্ত হন। সুভাষ চন্দ্রের জয়ে জহরলাল সহ মোট 13 জন কংগ্রেস কার্যনির্বাহক সমিতির সদস্য পদত্যাগ করেন। 1939 খ্রিস্টাব্দের 29 শে এপ্রিল কলকাতায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের সভাপতির পদে ইস্তফা দেন। ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন।

ফরওয়ার্ড ব্লক : 1939 খ্রিস্টাব্দের 3রা মে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের অভ্যন্তরে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ নামে এক নতুন দল গঠন করেন। সুভাষ চন্দ্র এই নতুন দলের সভাপতি হন এবং পাঞ্জাবের সর্দার শার্দুল সিং কভিশের সহ সভাপতি হন। 11 ই আগস্ট শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে সুভাষ চন্দ্রকে তিন বছরের জন্য কংগ্রেসের কোন পদ গ্রহণের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url