পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন || Internal structure of the Earth

ম্যাগমা : ভূগর্ভের পদার্থ প্রচণ্ড চাপ ও তাপে গ্যাস, বাষ্প মিশ্রিত হয়ে গলিত অবস্থায় থাকলে তাকে ম্যাগমা বলে।

লাভা : ভূগর্ভের গলিত উত্তপ্ত অর্ধতরল ম্যাগমা ফাটল দিয়ে ভূপৃষ্ঠের বাইরে বেরিয়ে এলে তাকে লাভা বলে। ইন্দোনেশিয়ার আগ্নেয়গিরি থেকে গাঢ়, সান্দ্র একরকম লাভা নির্গত হয়। হাওয়াই দ্বীপের ভাষায় এর নাম ‘আ আ'। এই লাভা দ্রুত খুব বেশীদূর প্রবাহিত হয় না। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের আগ্নেয়গিরি গুলো থেকে অত্যন্ত পাতলা লাভা বেরিয়ে বহুদূর প্রবাহিত হয়। হাওয়াই দ্বীপের ভাষায় এর নাম ‘পা হো হো'।

ভূতাপ শক্তি : ভূ-তাপ হল এক ধরনের শক্তি। পৃথিবীর কেন্দ্রের তাপ ধীরে ধীরে বাইরের দিকে অর্থাৎ পৃথিবীপৃষ্ঠের দিকে আসতে থাকে। এই তাপ শক্তিকে ভূতাপ শক্তি বলে। পৃথিবীর বহু দেশে এই তাপ শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। আইসল্যান্ড তাদের দেশে বিদ্যুতের চাহিদার প্রায় 30 শতাংশ ভূতাপ শক্তি দ্বারা মেটায়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভূতাপ শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রতি 33 মিটার দূরত্বে 1 ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়।

পৃথিবীর ঘনত্ব : ভূপৃষ্ঠের গড় ঘনত্ব মাত্র 2.6 থেকে 3.3 গ্রাম/ঘন সেমি। পৃথিবীর কেন্দ্রের কাছে পদার্থের গড় ঘনত্ব প্রায় 11 গ্রাম/ঘন সেমি। পৃথিবীর একেবারে কেন্দ্রে ঘনত্ব প্রায় 13-14 গ্রাম/ঘন সেমি। কৃত্রিম উপগ্রহের বিচারে সামগ্রিকভাবে পৃথিবীর গড় ঘনত্ব 5.5 গ্রাম/ঘন সেমি।

পৃথিবীর অভ্যন্তরভাগের গঠন : ভূমিকম্পের তরঙ্গের গতিবিধি লক্ষ্য করে পৃথিবীর অভ্যন্তর সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। ভূমিকম্পের P তরঙ্গ ভূ-অভ্যন্তরের কঠিন তরল যেকোনো মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। কিন্তু S তরঙ্গ তরল বা অর্ধতরল মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে না। ভূমিকম্প তরঙ্গ ও আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ থেকে বেরোনো লাভা পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রধানত তিনটি স্তরের সন্ধান পেয়েছেন। একেবারে উপরে আছে ভূত্বক (Crust)। ভূত্বকের নিচে আছে গুরুমন্ডল (Mantle) এবং একেবারে নিচে বা পৃথিবীর কেন্দ্রের চারিদিকে অবস্থান করছে কেন্দ্রমন্ডল (Core)।

ভূত্বক : মহাসাগরের নিচে ভূত্বক গড়ে 5 কিমি এবং মহাদেশের নিচে গড়ে 60 কিমি গভীর। ভূত্বকের গড় গভীরতা প্রায় 30 কিমি। মহাসাগরের নিচে প্রধানত সিলিকন (Si) এবং ম্যাগনেসিয়াম (Mg) দিয়ে তৈরি স্তরটি হল সিমা (SIMA)। এই স্তর তুলনামূলকভাবে বেশি ভারী। প্রধানত ব্যাসল্ট জাতীয় আগ্নেয় শিলা এই স্তর গঠন করেছে। এর ঘনত্ব 2.9 গ্রাম/ঘন সেমি। মহাদেশের নিচে প্রধানত সিলিকন(Si) এবং অ্যালুমিনিয়াম(Al) দিয়ে তৈরি ভূত্বকের উপরের স্তরটি হল সিয়াল (SIAL)। গ্রানাইট জাতীয় আগ্নেয় শিলা এই স্তর গঠন করেছে। এই স্তর সীমার চেয়ে হালকা এবং একটানা নয়। সমুদ্রের নিচে এই স্তর অনুপস্থিত। সীমা বা মহাসাগরীয় ভূত্বকের উপরে সিয়াল অবস্থান করছে। ভূত্বকের বেশিরভাগ অংশ প্রায় 47 শতাংশ জুড়ে আছে অক্সিজেন।  ভূত্বকের দ্বিতীয় প্রধান উপাদান হলো সিলিকন।

বিযুক্তি রেখা : ভূপৃষ্ঠ থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত যেখানে যেখানে ভূমিকম্পের তরঙ্গের গতিবেগ পরিবর্তন হয় সেখানটা কে ভূতত্ত্ববিদরা বলেন বিযুক্তি রেখা (Discontinuity)। বিযুক্তি রেখা দ্বারা দুটি ভিন্ন উপাদান ও ঘনত্বের স্তর কে আলাদা করা যায়। সিয়াল ও সিমা স্তরের মাঝে আছে কনরাড বিযুক্তি রেখা।

গুরুমন্ডল : ভূত্বক ছাড়িয়ে পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রায় 2900 কিমি পর্যন্ত একই ঘনত্ব যুক্ত স্তর হলো গুরুমন্ডল। এই স্তরের উষ্ণতা 2000° C – 3000° C । পদার্থের ঘনত্ব 3.4 - 5.6 গ্রাম/ঘন সেমি। পৃথিবীর মোট আয়তনের প্রায় 84 শতাংশ গুরুমন্ডল দখল করে আছে। গুরুমন্ডলের 30 থেকে 700 কিলোমিটার পর্যন্ত অংশে ক্রোমিয়াম(Cr), লোহা(Fe), সিলিকন(Si) ও ম্যাগনেসিয়াম(Mg) এর প্রাধান্য দেখা যায় এটি হলো ক্রফেসিমা(Cro+Fe+Si+Ma) স্তর। আর গুরুমন্ডল এর 700 থেকে 2900 কিলোমিটার পর্যন্ত অংশে নিকেল(Ni), লোহা(Fe), সসিলিকনSi) ও ম্যাগনেসিয়াম(Ma) এর প্রাধান্যের জন্য এই স্তর হলো নিফেসিমা(Ni+Fe+Si+Ma)। ভূত্বক ও গুরুমন্ডল এর মাঝে আছে মোহোরোভিসিক বিযুক্তি রেখা (Mohrovicic Discontinuity) বা মোহো বিযুক্তি রেখা। ক্রফেসিমা ও নিফেসিমার মাঝে আছে রেপিত্তি বিযুক্তিরেখা (Repetto Discontinuity)।

অ্যাস্থেনোস্ফিয়ার : ভূত্বক ও গুরুমন্ডল এর উপরই অংশ নিয়ে গঠিত হয়েছে শিলামন্ডল। এর গভীরতা প্রায় 100 কিমি। শিলামন্ডলের নিচে গুরুমন্ডলের উপরের অংশে বিশেষ স্তরটি হল অ্যাস্থেনোস্ফিয়ার। Asthenosphere একটি গ্রিক শব্দ, যার মানে দুর্বল স্তর। এই স্তরে পদার্থ গলিত ও নরম প্রকৃতির। অত্যধিক তাপ ও চাপে এখানকার শিলা সান্দ্র অর্থাৎ অর্ধতরল অর্ধ কঠিন অবস্থায় আছে। ভূগর্ভের তাপে পদার্থ গুলি উত্তপ্ত হয়ে উপরের দিকে উঠে এসে অনুভূমিকভাবে প্রবাহিত হয়। আবার ওপরের অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা, ভারী পদার্থ নিচের দিকে নেমে যায়। এইভাবে পরিচলন স্রোতের সৃষ্টি হয়। ভূকম্পন তরঙ্গ এই স্তরের মধ্যে দিয়ে অপেক্ষাকৃত ধীর গতিতে প্রবাহিত হয়।

কেন্দ্র মন্ডল : ভূত্বক ও গুরুমন্ডলের পরবর্তী এবং কেন্দ্রের চারদিকে বেষ্টনকারী শেষ স্তরটি হল কেন্দ্রমন্ডল। এই স্তরটি প্রায় 3500 কিমি পুরু। অত্যন্ত ভারী নিকেল(Ni) এবং লোহা(Fe) দিয়ে তৈরী বলে একে নিফে(Nife) বলে। এর গড় তাপমাত্রা প্রায় 5000° সেন্টিগ্রেড। এই স্তরের ঘনত্ব প্রায় 9.1 থেকে 13.1 গ্রাম/ঘন সেমি। পদার্থের ঘনত্ব, উষ্ণতা, চাপ প্রভৃতির ওপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীরা কেন্দ্রমন্ডলকে দুটি অংশে বিভক্ত করেন - অন্তঃকেন্দ্রমন্ডল ও বহিঃকেন্দ্রমন্ডল। গুরুমন্ডল ও কেন্দ্রমন্ডলের মাঝে আছে গুটেনবার্গ বিযুক্তি রেখা (Gutenberg Discontinuity)। অন্তঃ কেন্দ্রমন্ডল ও বহিঃ কেন্দ্রমন্ডলের মধ্যে আছে লেহম্যান বিযুক্তি রেখা (Lehman Discontinuity)।

অন্তঃকেন্দ্রমন্ডল : এই স্তর পৃথিবীর একেবারে কেন্দ্রের চারদিকে রয়েছে। এই স্তরের গভীরতা 5100 কিমি থেকে প্রায় 6370 কিমি। এর চাপ ও ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। অত্যধিক চাপের ফলে পদার্থগুলি এখানে কঠিন অবস্থায় আছে।

বহিঃ কেন্দ্রমন্ডল : অন্তঃ কেন্দ্রমন্ডলের চারদিকে রয়েছে বহিঃ কেন্দ্রমন্ডল। এই স্তর 2900 কিমি থেকে 5100 কিমি পুরু। এর চাপ, তাপ ও ঘনত্ব অন্তঃ কেন্দ্রমন্ডলের তুলনায় কম। এই স্তর অর্ধ কঠিন অবস্থায় পৃথিবীর অক্ষের চারদিকে আবর্তন করে চলেছে। সান্দ্র অবস্থায় থাকা এই লোহা প্রচন্ড গতিতে ঘুরতে ঘুরতে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি করেছে। যেখান থেকেই সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীর চৌম্বকত্ব।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url